মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০১১

সরল রেখা-বক্র রেখাঃ সপ্তম পর্ব



অনেক দিন আগে মিলি তখন ছোট, বাবা-মায়ের সাথে মামার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলো। লাল একটা ফ্রক পরে সারাদিন মামাতো ভাই-বোন হাবিব আর সেলিনার সাথে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতো। হাবিবের তখন একটা সাইকেল ছিলো, সেই সাইকেলে চড়ে অনেক দূরে চলে যেতো ওরা তিনজনে। গ্রামের ডোবা থেকে শাপলা তুলে আনতো, কখনো গাছের ডালে উঠে বসতো আবার কখনোবা সামান্য ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করে কান্না করে সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরতো। একদিন সাইকেলে করে একসাথে বাসায় ফিরবার সময় এক রিকশার সাথে সংঘর্ষে পড়ে গিয়ে হাবিবের দুই হাতের কনুই ছিলে রক্ত ঝরতে লাগলো। সাদা ফুল হাতের সার্টে রক্তটা একটু বেশিই রক্ত লাগছিলো! মিলি সহ্য করতে পারে নি, মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলো।

শুক্রাবাদে রাস্তা পার হতে গিয়ে যখন বিদ্যুত গতিতে ধাবমান প্রাইভেট গাড়ির ধাক্কায় হাবিব ছিটকে পড়ে, মিলি তখনো কিছু বুঝে উঠতে পারে নি। বরঞ্চ মিলি ধাতস্থ হবার আগেই আশে পাশের কিছু মানুষ হৈ হৈ করে কয়েকটি বাস আর প্রাইভেট কার ভেঙ্গে ফেলে। মিলি যখন রক্তে ভিজে যাওয়া হাবিবের মাথাটা ওর বুকে জড়িয়ে ধরে, সাদা স্কুল ড্রেসটা যখন গাঢ় রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠে, তখনো কী করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছিলো না। হাবিবের দিকে তাকিয়ে শুধু বিড়বিড় করে ‘রক্ত, রক্ত’ বলে যাচ্ছিলো। এক সত্যিকারের বয়স্ক মানুষ যখন অজ্ঞান হাবিবকে সবচেয়ে কাছের স্কয়ার হাসপাতালের ইমার্জেন্সীতে নিয়ে গেলো, তখনো মিলি কিছু বুঝে উঠতে পারছিলো না, শুধু অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর রক্তে রাঙা হাতের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে ‘রক্ত, রক্ত’ বলে যাচ্ছিলো।

ইমার্জেন্সী ডাক্তার ছিলো রাহাত, মিলির কলেজের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী নওশাবার বড়ো ভাইয়া। নওশাবাদের বাসায় যাওয়ার সুবাদে মিলি রাহাতকে এবং রাহাত মিলিকে চিনতো। রাহাতই শেষ পর্যন্ত মিলির বাবা হাসান সাহেবকে ফোন করে হাবিবের এক্সিডেন্টের খবর জানায়। প্রায় সাথে সাথেই মিলির বাবা- মা হাসপাতালে চলে আসে। হাবিবের মাথার সিটি স্ক্যান করার পর ব্রেনের ভিতরে রক্তপাত দেখা যায়। সংকটাপূর্ণ অবস্থায় ওকে নিউরো আইসিইউ-তে ভর্তি করানোর পরেই মিলি হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করলো।
------------------------------------

সিরাজের রক্তের গ্রুপ ছিলো এ নেগেটিভ। কীভাবে যেনো শামার অফিসের কলিগ নাফিসের রক্তের গ্রুপও ছিলো এ নেগেটিভ। এক ব্যাগ রক্ত দিয়ে সিরাজকে দ্রুত অবনতির হাত থেকে রক্ষা করে এখন জেনারেল ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে। সিরাজের মা-কে খবর দেওয়ার পর উনি গ্রাম থেকে আসা অবধি সুর করে বিলাপই করে যাচ্ছেন। এক সময় শামার মনে হলো উনাকে খবর না দিলেই মনে হয় ভালো হতো। মিলন সেলিনাকে নিয়ে ঢাকার পথে রওয়ানা দেবার পরই শামা হঠাৎ করে অসহায় বোধ করতে লাগলো। ডাক্তারদের আচরণে যেনো আরো কুকড়ে যাচ্ছিলো সে। বহু কষ্টে একজন ডাক্তারকে পাওয়া যাবার পর, সে সিরাজকে একটু দেখে সিস্টারকে কি কি রক্ত পরীক্ষা করতে হবে বলে কোথায় যেনো আবার চলে গেলো। এই সময় যদি নাফিস না থাকতো, তাহলে শামা একা সামলাতে পারতো না। যখন জানা গেলো সিরাজের রক্তের গ্রুপ এ নেগেটিভ, নাফিস নিজে থেকেই রক্ত দিতে এগিয়ে আসলো।

নাফিসের সাথে শামার পরিচয় বেশি দিনের নয়। শামা বিদেশী এনজিওটির যে ব্রাঞ্চে কাজ করে, সেই ব্রাঞ্চের প্রধান হয়ে কিছু দিন আগে নাফিস আসে। মার্জিত, সুদর্শন নাফিসকে প্রথম দিন থেকেই অফিসের সবাই পছন্দ করা শুরু করে। বস সুলভ অহমিকার চাইতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই যেনো নাফিসের কাজের মূলমন্ত্র। সহকর্মীদের কাজের স্বাধীনতায় সম্পূর্ণ বিশ্বাসী সে। অন্যদিকে শামা ছোট বেলা থেকেই আত্মসচেতন, স্বাধীনচেতা। ও যা বিশ্বাস করে, তা সরাসরি বলতে যেমন পিছপা হয় না, তেমনি ওর প্রতিটি কাজেও থাকে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসের ছাপ। যে কারণে সিরাজ যখন শামাকে ভালোবাসার কথা জানায়, শামা লুকোচুরির মধ্যে না গিয়ে সরাসরি সিরাজকে জানিয়ে দেয় সিরাজের জন্য ওর হৃদয়ে ভালোবাসা আছে, একজন খুব প্রিয় বন্ধু হিসেবে, কিন্তু প্রেমিক হিসেবে চিন্তার বাইরে। এই হচ্ছে শামা। আর এই শামাকেই প্রথমবার দেখেই ভালোবাসার মাতাল হাওয়ায় হারিয়ে যায় নাফিস। নাফিসকে শামারও খারাপ লাগে নি। কিন্তু সম্মতি দেবার আগে শামা চেয়েছিলো, নাফিস যাতে ওর পরিবারকে দেখে, ওর মূলটাকে চিনে। সেই মূল চেনানোর জন্যই আজ সে নাফিসকে সাথে নিয়ে বাসায় আসছিলো। বাসায় এসেই দেখতে পেলো সিরাজ অজ্ঞান হয়ে আছে।

শামা দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলো, নাফিস ডাক্তারের সাথে কথা বলছে। দেখতে খুব সুন্দর লাগছে, হাত নেড়ে কী যেনো ডাক্তারকে বোঝাচ্ছে! মনে হচ্ছে সেই ডাক্তার! হেসে ফেললো শামা। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো এই ছেলেটাকে সে ‘না’ বলতে পারবে না। একটু পর নাফিস এসে যখন শামাকে বলতে লাগলো, ডাক্তার বলেছে সিরাজের বিপদ কেটে গেছে, ওর আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে অতিরিক্ত এলকোহল সেবনের জন্য ফ্যাটি লিভার দেখা গেছে, আর মারাত্নক কিছু নেই, দুই একদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে, তখন কোনো কিছুই যেনো শামা শুনতে পাচ্ছিলো না। বিহ্ববল নয়নে নাফিসের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলতে লাগলো,



“শুনি আপন বুকের দুরুদুরু
সেখানে এক মত্ত আগ্নতুক,
রক্তকণায় তুলেছে তোলপাড়
সেখানে সুখ, আমার সুখ”।




--------------------------------

বাসে করে যখন মিলন সেলিনাকে নিয়ে ঢাকার দিকে আসতে লাগলো, চিন্তা করছিলো এই অবস্থায় কীভাবে বেপারী পাড়ার বাড়ির কথাটা সেলিনাকে বলবে। একেতো সেলিনা কখনো এসব ব্যাপার নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে নি, তার উপর হাবিবের ঘটনাতে খুব চুপ হয়ে গেছে। বাসে একসাথে প্রায় দুই ঘন্টা হয়ে গেছে, কোনো কথা সেলিনা বলেনি, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। মাঝে একবার ওর ফুফু ফোন করেছিলো। ডাক্তার না কী বলেছে এক্সিডেন্টের পর মাথায় রক্তপাত হয়েছে, যাকে বলে এপিডুর্যারল হেমাটোমা। স্কয়ার হাসপাতালের অভিজ্ঞ ভারতীয় ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে অপারেশন করেছে, এখন নিউরো আইসিইউ-তে আছে, তবে এখনো জ্ঞান ফিরে নি। ডাক্তার আশা করছেন পনের থেকে বিশ দিনের ভিতরে হাবিব অনেক খানি সুস্থ হয়ে উঠবে। এই কথা গুলো ফুফুর কাছ থেকে শুনে সেলিনা মিলনকে জানিয়ে আবার বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। মিলন একটু ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললো, ‘সেলিনা, তোমাদের বেপারী পাড়ায় যে বাড়িটা আছে, সে টা সড়ক সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে ভাঙার জন্য দ্বিতীয় এবং শেষ নোটিশ দিয়েছে। ভাঙ্গা বন্ধ করার জন্য এখনই কিছু একটা করা উচিৎ। এই মুহুর্তে হাবিবের এই অবস্থা, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কি করা উচিৎ’। সেলিনা পুরো কথাটি শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো, তারপর কোমল অথচ দৃঢ় কন্ঠে বললো, ‘মিলন ভাইয়া, আপনাকে খুব বিপদে ফেলে দিয়েছি আমি। আপনি আমাদের জন্য অনেক করছেন। খুব কৃ্তজ্ঞ আমি। বেপারী পাড়ার বাড়িটি নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি এটা ফুফাকে বলবো। উনি নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করবেন’। সেলিনার কথাগুলো যেনো চাবুক মারার মতো সপাং করে মিলনের পিঠে গিয়ে লাগলো। মিলন খেয়ালই করেনি হাবিবের ফুফা ঢাকার একটি বড়ো ব্যাংকে পরিচালক পদে আছেন। তাঁর পক্ষে আদালত থেকে স্টে-অর্ডার বের করে আনা কোনো ব্যাপারই নয়। কিন্তু মিলনকে বিস্মিত করেছে সেলিনার কথা বলার ভঙ্গীটি। মেয়েরা মনে হয় কোনো শক্ত আঘাত পেলেই মানসিকতায় পরিবর্তিত হয়ে যায়। মিলন আর কোনো কথা বললো না, পুরো যাত্রা পথেই এক অসহনীয় নিরবতা দুই জনকেই ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছিলো, মিলনের যেনো মনে হচ্ছিলো,


“নদীর কিনারে গিয়ে মনে পড়ে নদীর চেয়েও উত্তাল সুগভীর নারীকে
সন্ধের আকাশ কী অকপট, বাতাসে কোনো মিথ্যে নেই,
তখন খুব আস্তে, ফিসফিস করে, প্রায়
নিজেরই কানে-কানে বলি,
একটা মানুষ জন্ম পাওয়া গেল, নেহাৎ অ-জটিল কাটলো না!”



----------------------------------------------

দিপ্ত মাত্র মেডিকেল পাশ করেছে। রাজধানী শহরের একটি নামকরা বেসরকারী মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করেই সে স্কয়ার হাসপাতালে জয়েন করেছে। ওর বাবা স্কয়ার টয়লেট্রিজের এক বড়ো পদে কর্মরত আছেন, তাই দিপ্তের এই চাকরীটা পেতে খুব একটা কষ্ট হয় নি। এখানে আসার পর দেখলো, অনেকেরই চাকরী হয়েছে লবিংয়ের মাধ্যমে। ওকে দেওয়া হয়েছে নিউরো আইসিইউতে। আইসিইউ-এর ম্যান্যাজমেন্ট সম্পর্কে ওর আসলে তেমন ধারণা নেই। তার উপর আজকেই প্রথম নাইট ডিউটি। দিপ্ত আরেকটি ব্যাপার নিয়ে আজ একটু অস্বস্তিতে আছে। আজ রাতের অনকল ডাক্তার হচ্ছেন সিলভা পান্ডিয়ান স্যার, ইন্ডিয়ান, দিপ্ত এখনো তাঁর সাথে সহজভাবে কথা বলতে পারে না। হয় সে সিলভা পান্ডিয়ানের কথা বুঝে না, নতুবা সিলভা পান্ডিয়ান দিপ্তের কথা ঠিকমতো বুঝতে পারেন না। আজ রাতে আবার এক খারাপ রোগী আছে। বিকেলের দিকে সিলভা পান্ডিয়ান স্যার ইমার্জেন্সী ক্রানিওটমি অপারেশন করেছেন। রোগীর নাম হাবিব। রাস্তা পার হতে গিয়ে প্রাইভেট কারে চাপা পড়েছিলো। দিপ্ত আইসিইউ-এর এসি রুমে বসে একটা খিস্তি দিয়ে বসলো, ‘শালা, এরা রাস্তাও পার হতে পারে না। আরে বাবা, এক্সিডেন্ট যখন করেছিস, মারা যা, তাহলে আজকে রাতটা ঘুমাতে পারতাম। বেঁচে থেকেতো আমারে বিপদে ফেললি’।

মধ্যরাতে দিপ্তের যখন তন্দ্রামতো হচ্ছিলো, সিস্টার ওকে জানালো হাবিব নামের রোগীটির ব্লাড প্রেশার দ্রুত কমে যাচ্ছে, দুই চোখের মনি অসমান। আইসিইউতে অনভিজ্ঞ দিপ্ত ব্যাপারটির গুরুত্ব অনুধাবন করতেই কিছুটা সময় নিলো। তারপর যখন ফোনে সিলভা পান্ডিয়ানকে জানালো, সিলভা পান্ডিয়ানের দিপ্তের কথা বুঝতে আরো কিছুটা সময় গেলো। রাত তিনটার সময় যখন সিলভা পান্ডিয়ান দ্বিতীয় বারের মতো হাবিবকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলেন, তখন সেলিনা আর মিলি দুই জনই একে অপরের হাত শক্ত করে ধরে ওটির সামনে বসে রইলো।

ফযরের নামাজের সময় অপারেশন শেষ করে ভারতীয় ডাক্তার সিলভা পান্ডিয়ান হাবিবের ফুফাকে বললেন, ‘ব্রেনের প্রেশার বেড়ে যাওয়াতে প্রথমবারের অপারেশনের জায়গায় আবার রক্তপাত হয়। সেই রক্তপাতটা বন্ধ করতেই আবার এই অপারেশন। তবে এবার ব্রেইনের কিছু সুস্থ অংশও নষ্ট হয়েছে। তাই বলা যাচ্ছে না, রোগীর অবস্থা কেমন হবে। খুব সম্ভাবনা আছে অনেকদিন যাবত বিছানায় পড়ে থাকার’। দিপ্ত এইসব কথা শুনে চিন্তা করছিলো কি দরকার এইসব কথা রোগীর লোকদের বলার, ইন্ডিয়ানরা আসলেই কেমন যেনো! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো আর দুই ঘন্টা বাকী আছে ওর ডিউটি শেষ হতে। দিপ্তের আরো একটি ব্যাপারে আজ মেজাজ খুব ভাল নেই। আজ থেকেই রোজা শুরু হয়েছে, অথচ সেহেরীর সময় স্যারের সাথে ওটিতে থাকতে হয়েছে, কিছু খাওয়া দাওয়াও করতে পারে নি। একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিপ্ত ভাবলো, কী জঘন্য একটা রাত গেলো আজ!





1 টি মন্তব্য:

  1. Niaz,
    Lekha porlam, agerguluo porlam. Tor lekhata kemon jeno aki typed hoye jacce. jai hok akane amar kicu bepare confusion toiri hoyece.
    1) protom porbe bola holo je Habib,Milon r Siraj matro H.S.C porikkha dilo, result-o daini.
    2) Siraj-er ballo-belar(!) bhondhu holo Shama
    3) Shama ki jhogghota bole bideshi N.G.O te chakri kore? Sirajer sathe dorleto se S.S.C pass! Ar N.G.O er boss hole to Nafiz bhaloi senior.( ami bolci na je prem korte parbe na, kintu ai boyece Nafiz biyer prostab dibe.atai shababik)
    amar mone hoy ai khudro jinish gulu bhalo nojor dewa uchit.

    উত্তরমুছুন