শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

গ্রীক মিথলজি ৭ (ডিওক্যালিয়নের বন্যা)

জিউস যখন স্বর্গের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে, সব দেবতাদের রাজা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছিলেন, সেই সময়ে পৃথিবীতে একজন মানুষ বাস করতেন, যার নাম ছিলো ডিওক্যালিয়ন। ডিওক্যালিয়ন ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ। কিন্তু তার বাবা ছিলেন অসাধারণ একজন!


তিনি ছিলেন মানববন্ধু টাইটান প্রমিথিউস। ডিওক্যালিয়নের মা-ও ছিলেন একজন ওসেনিড, প্রোনোয়া। কিন্তু ডিওক্যালিয়ন কোনো টাইটান ছিলেন না! তিনি ছিলেন শুধুই একজন সাধারণ মানুষ, কিন্তু আচার-নিষ্ঠায়, ব্যবহারে সবদিকে অসাধারণ। ডিওক্যালিয়ন খুব ধার্মিকও ছিলেন।


ডিওক্যালিয়ন বিয়ে করেছিলেন পীরাকে। পান্ডোরার কথা মনে আছে? বিশ্বের প্রথম মানবী? পীরা ছিলেন সেই পান্ডোরা এবং টাইটান এপিমেথিয়াসের কন্যা। পীরাও ডিওক্যালিয়নের মতো যেমন ধার্মিক ছিলেন,তেমনি ছিলেন মা পান্ডোরার মতো খুব সুন্দরীও।


ককেশাস পাহাড়ে প্রমিথিউসকে বন্দী করে রাখার সময়ে, পান্ডোরার জারের মাধ্যমে জিউস যখন সব রোগ এবং খারাপ জিনিস পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন, তখন মানুষ খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। তারা শান্তিতে বসবাস না করে, একে অপরের সাথে হানাহানি আর যুদ্ধ করতে লাগলো। ছিলো না কোনো আইনের শাসন। জিউস মানবজাতিকে যেভাবে শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন, সেভাবেই যেনো সবকিছু ঘটছিলো।


সেই সময়ে গ্রীসের আর্কাডিয়ার রাজা ছিলেন লাইকায়ন। তার ছিলো পঞ্চাশ জন পুত্র সন্তান (কারো মতে, বাইশ জন)। বলা হয়ে থাকে এযাবতকালে লাইকায়ন ও তার পঞ্চাশ জন পুত্রের মতো কোনো অহংকারী এবং অধার্মিক মানুষ পৃথিবীতে জন্ম নেয়নি। জিউসও এটি জানতেন। তবুও তিনি নিজ চোখে দেখার জন্য মানুষের ছদ্মবেশে আর্কাডিয়ায় এলেন। আর্কাডিয়ায় আসার আগে অবশ্য তিনি আর্কাডিয়ার অধিবাসীদের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তিনি আসবেন। তাই অনেক মানুষ হঠাৎ করেই খারাপ কাজ ছেড়ে দিয়ে জিউসের উপাসনা শুরু করলো।


কিন্তু লাইকায়ন তাদের উপাসনাকে উপহাস করে বললো, “আমি খুব দ্রুতই বের করবো, সে কি দেবতা, না কি মরণশীল কোনো মানুষ?”
জিউস ছদ্মবেশে এসে রাতে তার প্রাসাদে অবস্থান করছিলেন। রাতের খাবারের সময় লাইকায়ন ও তার পুত্ররা এক বালককে হত্যা করে, সেই বালকের মাংস রান্না করে জিউসের সামনে দিলেন। রাগে ক্ষুদ্ধ হয়ে জিউস সঙ্গে সঙ্গে লাইকায়নকে নেকড়ে মানবে পরিণত করেন, এবং বজ্র বিদ্যুৎ দিয়ে তার প্রাসাদ গুড়িয়ে দেন, একই সাথে লাইকায়নের সব সন্তানেরই একই পরিণতি করেন, শুধুমাত্র নিকটিমোস ছাড়া।


লাইকায়ন নেকড়ে মানবে পরিণত হলো (শিল্পী- গোল্টজিয়াস, ১৫৮৯ সাল) লাইকায়ন নেকড়ে মানবে পরিণত হলো (শিল্পী- গোল্টজিয়াস, ১৫৮৯ সাল)

কেউ কেউ বলেন, নিকটিমোস গায়ার কারণে রক্ষা পেয়েছিলেন, আবার কেউ কেউ বলেন নিকটিমোসকে হত্যা করে তার মাংস জিউসের সামনে খাওয়ার জন্য আনা হয়েছিলো। পরে জিউস নিকটিমোসকে পুনর্জীবিত করেন। ঘটনা যেটাই হোক, লাইকায়নের পঞ্চাশ পুত্রের মধ্যে শুধু নিকটিমোস জীবিত ছিল এবং লাইকায়নের পর আর্কাডিয়ার রাজা হোন।


Zeus destroys the house of Lycaon 2 as the latter turns into a wolf জিউস বজ্র দিয়ে লাইকায়নের প্রাসাদ গুড়িয়ে দিচ্ছে, সাথে তার সন্তানদেরও


লাইকায়ন এবং তার ছেলেদের শাস্তি দিয়েও জিউস শান্ত হলেন না। তিনি অন্য দেবতাদের বললেন, “এই মানুষেরা আমাদের জন্য সমস্যা ছাড়া কিছুই না! যখন তারা সুখে, শান্তিতে থাকতো, আমরা ভয় পেয়েছিলাম তারা আমাদের চেয়ে বড় হয়ে উঠবে, আর এখন তারা এতোটাই খারপ এবং নৃশংস হয়েছে, সেটাও আমাদের জন্য বিপদজনক। তাদেরকে নিয়ে একটিমাত্র কাজ করা যায়, আর সেটি হচ্ছে তাদেরকে ধ্বংস করে ফেলা। আর তাছাড়া, আমি মাত্র একটি বাড়ি ধ্বংস করেছি, তাহলে বাকীগুলো নয় কেনো?”


জিউস তখন সৃষ্টি করলেন মহা-প্লাবন। তিনি তাকে সাহায্য করার জন্য ডেকে পাঠালেন সমুদ্র দেবতা পসাইডনকে। তারা দু’জনে স্বর্গ থেকে মুষলধারে বৃষ্টি ঝরিয়ে এবং নদীগুলোর দুকূল ছাপিয়ে জলে ডুবিয়ে দিলেন পৃথিবীকে। পশু, মানব সব ডুবে গেলো সেই প্লাবনে। সমগ্র পৃথিবী পরিণত হলো এক মহাসাগরে, যেখানে তীরের কোনো দেখা নেই।


এদিকে, ডিওক্যালিয়ন কখনই কোনো খারাপ কাজে জড়িত ছিলেন না, এবং মানুষদেরকে বলতেন, “তোমরা যে অধর্মের কাজ করছ, এতে দেবতারা রুষ্ট হচ্ছেন। সেদিন আর বেশি দূরে নেই, যেদিন তোমরা এর জন্য প্রায়শ্চিত্ত করবে”। ডিওক্যালিয়ন প্রতিবছর ককেশাস পাহাড়ে যেতেন, তার বন্দী বাবা প্রমিথিউসের সাথে দেখা করার জন্য। প্রমিথিউস আগেই বলে দিয়েছিলেন, “সময় এসে গেছে সেই মহা প্লাবনের। প্রস্তুতি নাও বেঁচে থাকার জন্য”।


ডিওক্যালিয়ন এই পরিস্থিতির জন্য আগে থেকেই একটি নৌকা তৈরী করে রেখেছিলেন। বন্যার পানি যখন বাড়তে শুরু করেছিলো, তখনই তিনি এবং তার স্ত্রী পীরা নৌকাতে উঠে আশ্রয় নেন। নয় দিন, নয় রাত ভাসতে ভাসতে অবশেষে এসে পৌঁছান পারন্যাসাস পাহাড়ের চূড়ায় এবং তারা যখন নৌকা থেকে বেরিয়ে এলেন, কোথাও কোনো প্রাণের চিহ্ন দেখতে পেলেন না, চারদিকে শুধু পানি আর পানি! কিন্তু তারা দুইজনই ধার্মিক ছিলেন, তাই জিউস তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেন এবং প্লাবনের পানি নামিয়ে দিলেন। পানি নেমে গেলে ধীরে ধীরে পৃথিবীও শুকনো হলো।


পীরা এবং ডিওক্যালিয়ন পারন্যাসাস পাহাড় থেকে নেমে এলেন, এবং দেখলেন এই মৃত পৃথিবীতে তারা দুইজনই মাত্র জীবিত প্রাণী। তারা দেখতে পেলেন একটি পিচ্ছিল এবং শৈবালময় মন্দির, সেটি ছিলো টাইটান দেবী থেমিসের মন্দির। সেটি তখনও পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় নি। তারা সেখানে গেলেন, উদ্ধারের জন্য দেবতাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন এবং একাকীত্ব ঘোচানোর জন্য থেমিস এবং জিউসের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। ঠিক তখন তারা তাদের পিছনে এক কন্ঠস্বর শুনলেন। তারা পিছনে ঘুরে দেখলেন, একটি পাথরের উপর রাজকুমারের মতো দেখতে একজন দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি ছিলেন অনেক লম্বা, তার চোখ ছিল নীল এবং চুলগুলো হলুদ। তার পাদুকায় এবং টুপিতে ছিল ডানা লাগানো, তিনি হাতে এমন একটি জিনিস পরিধান করেছিলেন যাতে সোনালী সাপ পেচিয়ে আছে। ডিওক্যালিয়ন বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি হচ্ছেন দেবরাজ জিউসের বার্তাবাহক। তারা অপেক্ষা করতে লাগলেন, হার্মিস কি বলে শোনার জন্য। (অনেকেই বলে থাকেন, হার্মিস নয়, দেবী থেমিস তাদের কাছে এসেছিলেন।)


“তোমরা কি কিছু প্রার্থনা করছ?”, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা যা চাও, সেটাই পাবে। বল, কি চাও?”
“আমরা মানুষ চাই। প্রতিবেশী, বন্ধু ছাড়া এই বিশাল পৃথিবীতে একা বেঁচে থাকা অসম্ভব ব্যাপার”, ডিওক্যালিয়ন জবাব দিলেন। 
“তোমাদের মাথা অবগুন্ঠিত করো, এবং তোমাদের পিছনে নিক্ষেপ করো তোমাদের মায়ের অস্থিসমূহকে,” এই কথা বলেই বাতাসে মিলিয়ে গেলেন হার্মিস। 
“এ কথা দ্বারা তিনি কি বুঝাতে চাইলেন?” জিজ্ঞাসা করলেন পীরা। 
“অবশ্যই আমি বুঝতে পারিনি,” জবাব দিলেন ডিওক্যালিয়ন, “কারণ, আমাদের দুইজনের মা ভিন্ন ভিন্ন দুইজন, এবং তারা দুইজনই মারা গেছেন! তবে আমাকে একটু চিন্তা করতে দাও। কে হোন আমাদের সকলের মা? গায়া মানে পৃথিবী হলো সবকিছুর মা, অর্থাৎ আমাদেরও মা। কিন্তু মায়ের অস্থিসমূহ বলতে কি বোঝাচ্ছে?”
“সম্ভবত নদীর ধারের পাথরগুলোকেই মায়ের অস্থি বলা হয়েছে,” বললেন পীরা, “চলো, আমরা পাথরগুলোকে জিউসের নাম নিয়ে পিছন দিকে নিক্ষেপ করতে থাকি”। কেউ কেউ বলেন, তারা থেমিসের নাম নিয়েছিলেন।


যখন একেকটি পাথর মাটিতে পড়তে লাগলো, তখন সেগুলো থেকে নতুন মানুষের সৃষ্টি হতে লাগলো। ডিওক্যালিয়ন যে পাথরগুলো ছুড়ে মেরেছিলেন, সেগুলো থেকে মানব, এবং পীরা যে পাথরগুলো ছুড়ে পেরেছিলেন সেগুলো থেকে মানবীর সৃষ্টি হলো। তাদেরকে বলা হতো ‘পাথর মানব’, এবং তারা ছিলো এক সুদৃঢ় ও দীর্ঘস্থায়ী প্রজন্ম, প্লাবনের পর নির্জীব হয়ে পড়া পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য যেমন প্রজাতির দরকার ছিলো, ঠিক তেমনই।



Deucalion and Pyrrha  create a new generation by throwing stones. ডিওক্যালিয়ন এবং পীরা পাথর ছুড়ে মানব-মানবীর সৃষ্টি করছেন


এরপর অন্যান্য প্রজাতির প্রাণীরা নিজে থেকেই সৃষ্টি হতে শুরু করলো। সূর্য যখন উদয় হওয়া শুরু করলো, তখন এসব প্রাণী সৃষ্টি হতে লাগলো, কিছুটা আগের রুপে, কিছুটা নতুন রুপে। এভাবেই নতুন প্রজাতির প্রাণীর উদ্ভব হলো এই পৃথিবীতে।


ডিওক্যালিয়ন এবং পীরাই শুধুমাত্র এই বন্যায় একমাত্র মানব-মানবী ছিলেন না, যারা বেঁচে গিয়েছিলেন। তারা ছাড়াও মেগারাস, জিউসের এক সন্তান, সারস পাখির শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠে জেরানিয়া পাহাড়ের চূড়ায় আশ্রয় নিয়ে বেঁচে যান, জেরানিয়া পাহাড়টিও বন্যায় ডুবে যায় নি। এছাড়া পেলিয়নের কেরাম্বাস এক নিম্ফের সাহায্যে ডানা পেয়ে উড়ে গিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থান করে জীবন রক্ষা করেন। 
একইভাবে পারন্যাসাস পাহাড়ের অধিবাসীরা (যে শহরটির গোড়া পত্তন করেন পারন্যাসাস- সমুদ্র দেব পসাইডনের পুত্র) নেকড়ের আওয়াজ শুনে ঘুম থেকে উঠে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে আশ্রয় লাভ করেছিলো।


ডিওক্যালিয়ন এবং পীরা থেকেও সন্তানের জন্ম হয়, তাদের মধ্যে হেলেন ছিলেন পুরো হেলেনিস্টিক সভ্যতার প্রথম পুরুষ।


(কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্যণীয়-


- ডিওক্যালিয়নের প্লাবনের অনেক ঘটনার সাথে নুহের প্লাবন বা সুমেরীয় মিথে প্লাবনের প্রচুর মিল পাওয়া যায়!
- দেবতারা বা ইশ্বর মানবজাতির উপর রাগান্বিত হয়ে প্লাবন দিচ্ছেন, এই রাগান্বিত হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে ইশ্বরে বা দেবতায় অবিশ্বাস এবং তাদের প্রতি আনুগত্যশীল না থাকা। এটি প্রায় এই সংক্রান্ত সব মিথেই দেখা যায়।
- এক যুগের মানুষের সাথে অন্য যুগের মানুষের অনেক পার্থক্য দেখা যায়, নতুনভাবে সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যাখ্যা দেওয়ার একটা চেষ্টা আছে!
- নতুন মানুষ তৈরী করার জন্য ডিওক্যালিয়ন এবং পীরাকে চোখ বন্ধ করে পিছন দিকে পাথর ছুড়তে হয়েছে, যাতে তারা মানুষ সৃষ্টির পদ্ধতি না দেখতে পারে! প্রায় একই ভাবে সমকামীতার জন্য যখন সোডম এবং গোমরাহকে ধ্বংস করা হয়, তখনও পিছন দিকে তাকাতে নিষেধ করা হয়েছিলো, কারণ কি মানব জাতির ধ্বংস প্রক্রিয়া না দেখানো?
- সব মিথেই শেষে দেখা যায়, শুধুমাত্র সম্পূর্ণ আনুগত্যশীল মানুষই বন্যার সময় বেঁচে থাকতে পেরেছেন। )

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন